সাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শন – সাফা ও মারওয়া সম্পর্কিত হাদীস ও রিওযায়াতসমূহ
তাফসীর আদ দুররে মানসূর- সূরা আল বাকারা:১৫৮ Tafsir ad durre manthur
দারুস সাআদাত গ্রন্থ
তাফসীর আদ দুররে মানসূর
স্বত্ব: দারুস সাআদাত
إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِنْ شَعَائِرِ اللَّهِ فَمَنْ حَجَّ الْبَيْتَ أَوِ اعْتَمَرَ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِ أَنْ يَطَّوَّفَ بِهِمَا وَمَنْ تَطَوَّعَ خَيْرًا فَإِنَّ اللَّهَ شَاكِرٌ عَلِيمٌ (158)
১৫৮. নিশ্চয়ই সাফা মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনসমূহের মধ্য হতে। অতএব যে ব্যক্তি এই ঘরের হজ করে অথবা উমরা করে তাহলে তার জন্য কোন দোষ নেই এই দুটির মধ্যে প্রদক্ষিণ করাতে। আর যে খুশিমনে ভালো কাজ করে তবে আল্লাহ তো গুণগ্রাহী ও সর্বজ্ঞ।
ইমাম মালিক মুআত্তায়, আহমদ, বুখারী, বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, ইবনে জারীর, ইবনে আবী দাউদ, ইবনুল আম্বারী তার মাসাহেফে, ইবনে আবী হাতিম এবং বায়হাকী তার সুনানে- হযরত আয়শা (রা) থেকে বর্ণনা করেন। উরওয়া (রহ) তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এই আয়াতের কি এটাই উদ্দেশ্য যে, কেউ যদি সাফা মারওয়ার সায়ী না করে তবে কোন সমস্যা নেই। আয়শা (রা) বললেন, হে আমার ভাতিজা! তুমি ভুল বলেছ, যদি এর অর্থ এটাই হত তবে ইবাদত এই রকম হত
فَلَا جنَاح عَلَيْهِ أَن لَا يطوّف بهما
যদি সে তাদের প্রদক্ষিণ না করে, তাহলে তার কোন দোষ নেই।
এই আয়াত নাযিল হয়েছে এই কারণে যে, আনসারগণ ইসলাম কবুল করার পূর্বে মান্নাত (মূর্তি) এর জন্য ইহরাম বাঁধত, তারা যার উপাসনা করত। আর যে এই মূর্তির জন্য ইহরাম বাঁধত সে সাফা মারওয়ার সায়ী থেকে বিরত থাকত। ঐ সময় আল্লাহ তাআলা এই আয়াত নাযিল করেন-
{إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِنْ شَعَائِرِ اللَّهِ} الْآيَة
আয়শা (রা) বলেন, অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা) সাফা মারওয়ার সায়ীকে সুন্নত করে দিয়েছেন। এখন সাফা মারওয়ার সায়ী পরিত্যাগ করা বৈধ নয়।
ইমাম আব্দ ইবনে হুমায়দ, বুখারী, তিরমিযী, ইবনে জারীর, ইবনে আবী দাউদ আল মাসোহেফে, ইবনে আবী হাতিম, ইবনুস সাকান এবং বায়হাকী- হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন। তাকে সাফা মারওয়ার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হল। তিনি বললেন, আমরা জাহিলিয়াতের যুগে সাফা মারওয়ার যিয়ারত করতাম। যখন ইসলাম আগমন করল তখন বিরত হলাম। অতঃপর আল্লাহ তাআলা إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِنْ شَعَائِرِ اللَّهِ আয়াতটি নাযিল করলেন।
ইমাম হাকীম আর তিনি এটাকে সহিহ বলেছেন এবং ইবনে মারদুবিয়াহ- হযরত আয়শা (রা) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, এই আয়াত আনসারদের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে। তারা জাহিলিয়াতের যুগে যখন ইহরাম বাঁধত তখন সাফা মারওয়ার মাঝে সায়ী করা তাদের জন্য বৈধ ছিল না। অতঃপর যখন আমরা (মদীনায়) আসলাম তখন তারা এই মাসআলা রাসূলুল্লাহ (সা) এর নিকট জিজ্ঞাসা করলো। তখন আল্লাহ তাআলা إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِنْ شَعَائِرِ اللَّهِ আয়াতটি নাযিল করলেন।
ইমাম ইবনে জারীর, ইবনে আবু দাউদ আল মাসাহেফে, ইবনে আবী হাতিম এবং হাকীম আর তিনি এটাকে সহিহ বলেছেন- হযরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, জাহিলিয়াতের যুগে শয়তানরা সারা রাত সাফা মারওয়ার মাঝে ব্যঙ্গ কবিতা আবৃত্তি করত। সাফা মারওয়ার মধ্যে মূর্তি ছিল যেটাকে তারা খোদা মনে করত। যখন ইসলাম আসল তখন মুসলমানরা আরয করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা কি সাফা মারওয়ার সায়ী পরিত্যাগ করব? কেননা এটা এমন এক কর্ম ছিল যা আমরা জাহিলিয়াতের যুগে করতাম। তখন আল্লাহ তাআলা এই আয়াত নাযিল করেন-
فَمَنْ حَجَّ الْبَيْتَ أَوِ اعْتَمَرَ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِ أَنْ يَطَّوَّفَ بِهِمَا
অতএব যে ব্যক্তি এই ঘরের হজ করে অথবা উমরা করে তাহলে তার জন্য কোন দোষ নেই এই দুটির মধ্যে প্রদক্ষিণ করাতে।
তিনি বলেছেন, এর মধ্যে কোন গুনাহ নেই সওয়াব ছাড়া।
ইমাম তাবরানী আল আউসাতে- হযরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আনসাররা আরয করল, সাফা মারওয়ার মাঝে সায়ী করা জাহিলিয়াতের যুগের কর্ম থেকে। তখন আল্লাহ তাআলা এই আয়াত নাযিল করলেন
{إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ} الْآيَة
ইমাম ইবনে জারীর- আমর বিন হুবায়শ থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আমি ইবনে উমর (রা)-কে {إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ} الْآيَة আয়াতের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, ইবনে আব্বাসকে গিয়ে জিজ্ঞাসা কর। মুহাম্মদ (সা) এর প্রতি যা নাযিল হয়েছে তার বিষয়ে সে বর্তমান লোকদের মধ্যে বেশী জানে। আমি ইবনে আব্বাস (রা) এর নিকট আসলাম। মাসআলা জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, ঐ দুই পাহাড়ের মধ্যে মূর্তি রাখা ছিল। যখন লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করল তখন সাফা মারওয়ার সায়ী বন্ধ হয়ে গেল। পরিশেষে এই আয়াত {إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ} الْآيَة নাযিল হল।
ইমাম ইবন জারীর- হযরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকে {إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِنْ شَعَائِرِ اللَّهِ} الْآيَة প্রসঙ্গে বর্ণনা করেন। কিছু লোক সাফা মারওয়ার সায়ী করা হতে বিরত থাকলে আল্লাহ তাআলা নাযিল করলেন যে, এটা আল্লাহ তাআলার নিদর্শনের মধ্য হতে। আর তার তাওয়াফ করা আল্লাহর নিকট পছন্দনীয়। তখন এই দুটির মাঝে সায়ী করা সুন্নত সাব্যস্ত হল।
ইমাম সাঈদ ইবনে মানসূর, আব্দ ইবনে হুমায়দ, ইবনে জারীর, ইবনুল মুনযির- আমের আশ শাবী থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, সাফায় এক মূর্তি ছিল যার নাম আসাফ আর মারওয়ায় এক মূর্তি ছিল যাকে নায়েলা বলা হত। জাহিলিয়াতের যুগে যখন লোকেরা বায়তুল্লার তাওয়াফ করত তখন সাফা মারওযার মধ্যেও সায়ী করত আর ঐ মূর্তি দুটিকে স্পর্শ করত। যখন রাসূলুল্লাহ (সা) তাশরীফ আনলেন তখন সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সাফা মারওয়াকে মূর্তির জন্য প্রদক্ষিণ করা হত। এর তাওয়াফ কোন নিদর্শন নয়। তখন আল্লাহ তাআলা এই আয়াত নাযিল করলেন {إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ} الْآيَة ।
সাফা মুযাক্কার বা পুঃলিঙ্গ, কারণ এর উপর যে মূর্তি ছিল তা ছিল মুযাক্কার। আর মারওয়া হল মুয়ান্নাস বা স্ত্রীলিঙ্গ, কারণ এর উপর যে মূর্তি ছিল তা ছিল মুআন্নাস।
ইমাম সাঈদ ইবনে মানসূর, আব্দ ইবনে হুমায়দ, ইবনে জারীর- হযরত মুজাহিদ থেকে বর্ণনা করেন। আনসাররা বলল, ঐ দুই পাথরের মাঝে সায়ী করা জাহিলিয়াতের যুগের আমল। তখন আল্লাহ তাআলা এই আয়াত নাযিল করলেন إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِنْ شَعَائِرِ اللَّهِ বললেন- এই আমল কল্যাণকর, যার ব্যাপারে আমি তোমাদেরকে বলেছি যে, যে এর তাওয়াফ করবে না, তাহলে তার উপর কোন আপত্তি নেই। فَمن تطوّع خيرا فَهُوَ خير لَهُ অতএব রাসূলুল্লাহ (সা) এটাকে নফল সাব্যস্ত করেন। অতএব এর তাওয়াফ করা সুন্নতের মধ্য হতে। আতা (রহ) বলেন, যদি আল্লাহ চাইতেন তবে কাবার স্থানে সত্তরটি ঘর পরিবর্তন করে দিতেন।
ইমাম ইবনে জারীর- হযরত কাতাদাহ (রহ) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, জাহিলিয়াতের যুগে তোমাদের লোকেরা সাফা মারওয়ার মাঝে সায়ী করত না। এজন্য আল্লাহ তাআলা এই আয়াত নাযিল করেন {إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِنْ شَعَائِرِ اللَّهِ} الْآيَة এই দুই পাহাড়ের মধ্যে সায়ী করা ইবরাহীম ও ইসমাঈল (আ) এর সুন্নত।
ইমাম আব্দ ইবনে হুমায়দ, মুসলিম, তিরমিযী, ইবনে জারীর, ইবনে মারদুবিয়াহ, বায়হাকী তার সুনানে- যুহরী থেকে আর তিনি উরওয়া (রহ) থেকে বর্ণনা করেন। আনসারের কিছু লোক জাহিলিয়াতের যুগে মানাত মূর্তির জন্য ইহরাম বাঁধত। মানাত মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী স্থানের মূর্তি ছিল। তারা বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা সাফা মারওয়ার মাঝে মানাত এর সম্মানের জন্য সায়ী করতাম না। এখন কি আমাদের এর মধ্যে তাওয়াফ করতে কোন অসুবিধা আছে? আল্লাহ তাআলা এই আয়াত নাযিল করলেন {إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِنْ شَعَائِرِ اللَّهِ} الْآيَة
উরওয়া (রহ) বলেন, আমি আয়শা (রা)-কে বললাম, সাফা ও মারওয়ার মধ্যে তাওয়াফ না করার ব্যাপারে আমি কোন পরোয়া করি না। আল্লাহ তাআলা বলেন-
فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِ أَنْ يَطَّوَّفَ بِهِمَا
(যে ব্যক্তি বায়তুল্লাহর হজ্জ করে বা উমরা করে) এতদুভয়ের তওয়াফ করায় তার কোন দোষ নেই।
আয়শা (রা) বললেন, হে আমার ভাগনে, তুমি কি দেখ না যে, আল্লাহ তাআলা বলেছেন, إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِنْ شَعَائِرِ اللَّهِনিশ্চয়ই সাফা মারওয়া হল আল্লাহর নিদর্শন। রাসূলুল্লাহ (সা) নিজেও তওয়াফ করেছেন এবং মুসলিমরাও তওয়াফ করেছেন।
যুহরী (রহ) বলেন, আমি এই ঘটনাটি আবূ বকর ইবন আবদুর রহমান, ইবন হারিছ, ইবন হিশাম (রহ) এর নিকট উল্লেখ করলে তিনি বলেন, এই হল ইলম। আমি আলিমদেরকে বলতে শুনেছি যে, যখন আল্লাহ তাআলা বায়তুল্লাহর তাওয়াফ এবং এবং সাফা মারওয়ার সায়ী করার নির্দেশ নাযিল করলেন তখন নবী (সা) এর নিকট আরয করা হল, আমরা জাহিলিয়াতের যুগে সাফা মারওয়ার সায়ী করতাম। আর আল্লাহ তাআলা বায়তুল্লাহর প্রদক্ষিণ করার নির্দেশ নাযিল করেছেন কিন্তু সাফা মারওয়র প্রদক্ষিণ করার বিষয়ে কিছু বলেন নি।
এখন যদি আমরা এর প্রদক্ষিণ না করি তবে কি তা আমাদের জন্য দোষনীয়? তখন আল্লাহ তাআলা এই আয়াত নাযিল করলেন {إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِنْ شَعَائِرِ اللَّهِ} الْآيَة আবূ বকর ইবন আবদুর রহমান বলেন, শোন! এই আয়াত উভয় দলের জন্য নাযিল হয়েছে যারা ঐ পাহারদ্বয়ের মাঝে সায়ী করেছে আর যারা করেনি।
ইমাম ওকী, আব্দুর রাযযাক, আব্দ ইবনে হুমায়দ, মুসলিম, ইবনে মাজাহ এবং ইবনে জারীর- হযরত আয়শা (রা) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আমার জীবনের শপথ! আল্লাহ তাআলা তার হজ ও উমরাহ পূর্ণ করবেন না, যে সাফা মারওয়ার মাঝে সায়ী না করে। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেছেন- إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِنْ شَعَائِرِ اللَّهِ ।
ইমাম আব্দ ইবনে হুমায়দ এবং মুসলিম- হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আনসাররা সাফা মারওয়ার মাঝে সায়ী করা অপছন্দ করতেন। পরিশেষে এই আয়াত إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِنْ شَعَائِرِ اللَّهِ নাযিল হয় এবং এর মাঝে সায়ী করা নফল সাব্যস্ত হয়।
ইমাম ইবনে আবী দাউদ মুজাহিদ (রহ) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি পড়তেন- فَلَا جنَاح عَلَيْهِ أَن لَا يطوف بهما
ইমাম তাবরানী আল আউসাতে- হযরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি পড়তেন فَلَا جنَاح عَلَيْهِ أَن يطوّف অতএব যে তার তাওয়াফ ছেড়ে দিল, তার জন্য কোন অসুবিধা নেই।
ইমাম সাইদ ইবনে মানসূর, হাকীম- হযরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তার নিকট এক ব্যক্তি আসল এবং বলল, আমি মারওয়ার পূর্বে সাফার দ্বারা সায়ী শুরু করি। আর তাওয়াফের পূর্বে নামায পড়ি অথবা নামাযের পূর্বে তাওয়াফ। যবেহ করার পূর্বে মাথা মুণ্ডন করি অথবা মাথা মুণ্ডণের পূর্বে যবেহ করি।
ইবনে আব্বাস (রা) বললেন এই সবকিছু আল্লাহর কিতাব থেকে হাসিল কর, কারণ তা স্মরণ রাখার যোগ্য। আল্লাহ তাআলা বলেছেন
إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِنْ شَعَائِرِ اللَّهِ
নিশ্চয়ই সাফা ও মারওয়া হল আল্লাহর নিদর্শনের মধ্য হতে।
এর মধ্যে সাফা- মারওয়ার পূর্বে রয়েছে।
لَا تَحْلِقُوا رُءُوسَكُمْ حَتَّى يَبْلُغَ الْهَدْيُ مَحِلَّهُ
তোমরা মাথা মুণ্ডণ কর না, যে পর্যন্ত না কুরবানীর পশু উহার স্থানে পৌঁছে”-সূরা আল বাকারা ১৯৬
এই আয়াতে মাথা মুণ্ডন করা যবেহ করার পূর্বে রয়েছে।
وَطَهِّرْ بَيْتِيَ لِلطَّائِفِينَ وَالْقَائِمِينَ وَالرُّكَّعِ السُّجُود
আমার ঘরকে পবিত্র রেখো তাদের জন্য যারা তাওয়াফ করে এবং যারা সালাতে দাড়ায়, রুকু করে ও সাজদা করে।- সূরা হাজ ২৬
আর এই আয়াতে নামাযের পূর্বে তাওয়াফের কথা বলা হয়েছে।
ইমাম ওকী- হযরত সাঈদ ইবনে জুবায়র থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আমি হযরত ইবনে আব্বাস (রা)-কে জিজ্ঞাসা করলাম, সাফা থেকে সায়ী শুরু করা হয় কেন? তিনি বললেন, কেননা আল্লাহ তাআলা বলেছেন إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِنْ شَعَائِرِ اللَّهِ ।
ইমাম মুসলিম, তিরমিযী, ইবনে জারীর এবং বায়হাকী তার সুনানে- হযরত জাবির (রা) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, যখন রাসূলুল্লাহ (সা) তার হজে সাফার নিকটবর্তী হলেন, তখন পাঠ করলেন إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِنْ شَعَائِرِ اللَّهِ অতএব আল্লাহ তাআলা তার কালাম যার দ্বারা শুরু করেছেন তোমরাও তার দ্বারা শুরু কর। নবী (সা) সায়ী সাফা দ্বারা শুরু করেছেন এবং এর উপর আরোহণ করেছেন।
ইমাম শাফিয়ী, ইবনে সাদ, আহমদ, ইবনুল মুনযির, ইবনে কানে এবং বায়হাকী হাবীবাহ বিনতে বাহরান (তাজরাহ) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে সাফা মারওয়ার মাঝে সায়ী করতে দেখেছি যেখানে লোকেরা তার আগে ছিল আর তিনি লোকদের পিছনে সায়ী করছিলেন। এমনকি দ্রুত সায়ী করার কারণে তার হাটু দেখা যাচ্ছিল। তিনি (সা) তার পরিধেয় গুছিয়ে রাখছিলেন এবং বলছিলেন, তোমরা সায়ী কর কেননা আল্লাহ তাআলা সায়ী করা ফরয করেছেন।
ইমাম তাবরানী- হযরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন। রাসূলুল্লাহ (সা) এর নিকট (সাফা মারওয়ার সায়ীর ব্যাপারে) জিজ্ঞাসা করা হল। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন,
إِن الله كتب عَلَيْكُم السَّعْي فَاسْعَوْا
আল্লাহ তাআলা তোমাদের জন্য সায়ী ফরয করেছেন অতএব তোমরা সায়ী কর।
ইমাম ওকী- আবুত তুফায়ল আমের বিন ওয়াসেলা থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আমি হযরত ইবন আব্বাস (রা)-কে সাফা মারওয়ার মাঝে সায়ী করার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, ইবরাহীম (আ) সায়ী করেছিলেন।
ইমাম তাবরানী এবং বায়হাকী- আবু তুফায়ল থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আমি হযরত ইবনে আব্বাস (রা)-কে বললাম, আপনার সম্প্রদায়ের খেয়াল হল, রাসূলুল্লাহ (সা) সাফা মারওয়ার সায়ী করেছিলেন, তাই তা সুন্নত। ইবন আব্বাস (রা) বললেন, তারা সত্য বলেছে। যখন ইবরাহীম (আ) এর হজ করার আদেশ হল, তখন সায়ী করার মাঝে শয়তান তার সামনে আগমন করে। সে ইবরাহীম (আ) থেকে আগে বেড়ে যেতে চাইল। কিন্তু ইবরাহীম (আ) তার আগে অগ্রসর হয়ে গেলেন।
ইমাম হাকীম- হযরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি লোকদেরকে সাফা মারওয়ার মাঝে তাওয়াফ করতে দেখে বললেন, এটা ঐ বিষয়ের মধ্য হতে যা হযরত ইসমাঈল (আ) এর মাতা তোমাদেরকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রদান করেছেন।
ইমাম খতীব আত তালখীসে- হযরত সাঈদ ইবন জুবায়র (রহ) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, হযরত ইবরাহীম (আ) (মক্কায) তাশরিফ আনেন। আর তার সাথে হযরত হাজেরাহ ও ইসমাঈল (আ)-ও ছিলেন। তিনি তাদেরকে বায়তুল্লাহর নিকটে ছাড়লেন। হযরত হাজেরা বললেন, এ ব্যাপারে কি আপনার প্রতি আল্লাহর নির্দেশ আছে? ইবরাহীম (আ) বললেন, হ্যাঁ। অতঃপর (তিনি তাদেরকে সেখানে রেখে যাওয়ার পর) বাচ্চা পিপাসার্ত হলে হযরত হাজেরা দেখলেন যে, নিকটবর্তী পাহাড় হল সাফা। তিনি দৌড়ে তার উপর আরোহণ করেন। তিনি দেখলেন, তবে কিছুই নযরে আসল না। অতঃপর তিনি দেখলেন যে, নিকটবর্তী পাহাড় হল মারওয়া। তিনি (তার উপর আরোহণ করে) দেখলেন, তবে কিছুই নযরে আসল না। এটা ছিল সাফা মারওয়ার প্রথম সায়ী।
অতঃপর তিনি ফিরে আসলেন এবং ক্ষীণ একটি আওয়ায শুনলেন। সেই আওয়ায এটা ছিল যে, যদি তোমার কাছে পানি না থাকে তবে এদিকে আস। অতএব জিবরাঈল (আ) তার সামনে পায়ের গোড়ালী দ্বারা যমযমের (স্থানের) উপর আঘাত করেন, আর তাতে পানি বেরিয়ে আসে। তিনি কোন কিছু নিয়ে আসলেন যাতে সেখানে পানি জমা করতে পরেন। জিবরাঈল (আ) হযরত হাজেরাকে বললেন, তুমি পিপাসার জন্য ঘাবড়াচ্ছ? এটা আল্লার মেহমানদের শহর। এখানে (ক্ষুৎ) পিপাসার ভয় করো না।
ইমাম ইবনে আবী শায়বাহ, আবু দাউদ, তিরমিযী, হাকীম আর তিনি এটাকে সহিহ বলেছেন এবং বায়হাকী শুআবুল ইমানে- হযরত আয়শা (রা) থেকে বর্ণনা করেন। রাসূলূল্লাহ (সা) ইরশাদ করেন, বায়তুল্লাহর তাওয়াফ, সাফা মারওয়ার মাঝে সায়ী, রমী ও জিমার আল্লাহর স্মরণকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে, অন্য কিছুর জন্য নয়।
ইমাম আযরাকী- হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, সাফা মারওয়ার মাঝে তাওয়াফ করার সুন্নত এই যে, মানুষ সাফা থেকে নামবে এমনকি চলতে চলতে বত্বনে চলে যাবে। অতঃপর যখন এখানে পৌঁছবে তখন সায়ী করবে এবং এটা অতিক্রম করে মারওয়ার উপর আসবে।
ইমাম আযরাকী- হযরত ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি সাফার দিকে বের হলেন, অতঃপর সাফার প্রশস্ততায় দাড়িয়ে তালবিয়া পাঠ করলেন। আমি তাকে বললাম, লোকেরা এখানে الإِهلال-ইহলাল (তালবিয়া পাঠ) করতে নিষেধ করে। তিনি বললেন, আমি তোমাকে এর নির্দেশ প্রদান করছি। তুমি কি জান الإِهلال -ইহলাল কি? এটা হযরত মূসা (আ) এর তার প্রতিপালকের প্রতি কবুলিয়ত। যখন তিনি ওয়াদী প্রান্তরে আসেন, তখন তিনি রমল করেছিলেন এবং বলেছিলেন
رب اغْفِر وَارْحَمْ إِنَّك أَنْت الْأَعَز والأكرم
হে আমার প্রতিপালক! ক্ষমা করুন ও দয়া করুন। নিশ্চয়ই আপনি পরাক্রমশালী দয়ালু।
ইমাম তাবরানী এবং বায়হাকী তার সুনানে- হযরত ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি যখন সাফার প্রশস্ততায় দাড়ান তখন বলেন, কসম ঔ সত্তার যিনি ব্যতীত কোন মাবুদ নেই, এটা ঐ স্থান যেখানে সূরা আল বাকারা নাযিল হয়েছে।
أما قَوْله تَعَالَى: {وَمَنْ تَطَوَّعَ خَيْرًا}
আল্লাহ তাআলার বাণীঃ আর কেউ খুশিমনে ভালো কাজ করলে
ইমাম ইবনে আবু দাউদ আল মাসাহেফে- আমাশ থেকে বর্ণনা করেন যে আব্দুল্লাহর কিরাআতেوَمن تطوع بِخَير রয়েছে।
ইমাম সাঈদ ইবনে মানসূর- হযরত ইবনে উমর (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি সাফা মারওয়ায় দুআ করতেন। তিনবার তাকবীর বলতেন আর সাতবার এই কালিমা পাঠ করতেন-
لَا إِلَه إِلَّا الله وَحده لَا شريك لَهُ لَهُ الْملك وَله الْحَمد وَهُوَ على كل شَيْء قدير لَا إِلَه إِلَّا الله وَلَا نعْبد إِلَّا إِيَّاه مُخلصين لَهُ وَلَو كره الْكَافِرُونَ
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা) এত লম্বা দুআ করতেন যে, আমরা যুবক হওয়া সত্বেও ক্লান্ত হয়ে পড়তাম। তার দুআসমূহের মধ্যে এই বাক্যগুলোও ছিল
اللَّهُمَّ اجْعَلنِي مِمَّن يحبك وَيُحب ملائكتك وَيُحب رسلك وَيُحب عِبَادك الصَّالِحين اللَّهُمَّ حببني إِلَيْك وَإِلَى ملائكتك وَإِلَى رسلك وَإِلَى عِبَادك الصَّالِحين
اللَّهُمَّ يسرني لليسرى وجنبني للعسرى واغفر لي فِي الْآخِرَة وَالْأولَى واجعلني من الْأَئِمَّة الْمُتَّقِينَ وَمن وَرَثَة جنَّة النَّعيم واغفر لي خطيئتي يَوْم الدّين
اللَّهُمَّ إِنَّك قلت (ادْعُونِي أَسْتَجِب لكم) وَإنَّك لَا تخلف الميعاد اللَّهُمَّ إِذْ هديتني للإِسلام فَلَا تنزعه مني وَلَا تنزعني مِنْهُ حَتَّى توفاني على الإِسلام وَقد رضيت عني
اللَّهُمَّ لَا تقدمني للعذاب وَلَا تؤخرني لسيء الْفِتَن
হে আল্লাহ! আমাকে তাদের অন্তুর্ভুক্ত যারা তোমাকে মহব্বত করে, তোমার ফেরেশতাদেরকে মহব্বত করে, তোমার রাসূল ও তোমার নেক বান্দাদেরকে মহব্বত করে। হে আল্লাহ! আমাকে তোমার মহব্বত ও তোমার ফেরেশতাদের মহবব্বত, তোমার রাসূলদের ও নেক বান্দারে মহব্বত দান কর।
হে আল্লাহ! সহজ কাজ আমাদের জন্য সজ করে দাও আর দূরে রাখ আমাদেরকে কাঠিন্য থেকে। দুনিয়া ও অখিরাতে আমাকে মাফ করে দাও। আমাকে মুত্তাকীদের অন্তর্ভুক্ত কর এবং চিরস্থায়ী জান্নাতের অধিবাসী কর। কিয়ামতের দিন আমার ভুল ত্রটি ক্ষমা করে দাও।
হে আল্লাহ! তুমি নিজেই বলেছ, তোমরা আমার নিকট দুআ কর আমি তোমাদের দুআ কবুল করব। তুমি অঙ্গীকার ভঙ্গ কর না। হে আল্লাহ! যখন তুমি ইসলামের দিকে আমাকে পথ প্রদর্শন করেছ তখন আমার থেকে তা ছিনিয়ে নিও না এবং এর থেকে আমাকে পৃথক কর না, যে পর্যন্ত না আমার মৃত্যু ইসলামের উপর হয় এবং তুমি আমার প্রতি সন্তুষ্ট হও।
হে আল্লাহ! আমাকে অযাবের জন্য সামনে বাড়িয়ে দিও না আর ফিতনার জন্য পিছনে ছেড়ে দিও না।
ইমাম সাঈদ ইবন মানসূর ইবনে আবী শায়বাহ- হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, যে তোমাদের মধ্যে হজের জন্য আসে, তবে তার প্রথমে বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করা উচিত। তার সাত চক্কর দিবে অতঃপর মাকামে ইবরাহিমের পাশে দুই রাকাত নামায পড়বে। অতঃপর সাফার উপর আসবে এবং কিবলার দিকে মুখ করে দাড়িয়ে যাবে। অতঃপর সাতবার তাকবীর বলবে এবং প্রত্যেক দুই তাকবীরের মাঝে আল্লাহর প্রশংসা করবে। নবী (সা) এর প্রতি দরূদ প্রেরণ করবে। নিজের জন্য দুআ করবে। মারওয়ার উপরও এমন করবে।
ইমাম ইবনে আবী শায়বাহ আল মুসান্নাফে- হযরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন সাতটি স্থানে (দুআর জন্য) হাত উঠানো হয় (এবং দুআ কবুল হয়)। যখন নামাযের জন্য দাড়ায়, যখন বায়তুল্লাহর দিকে নযর পড়ে, সাফা মারওয়ার উপর, আরাফার ময়দানে, মুযদালিফায, দুই জামরার পাশে।
ইমাম শাফিয়ী আল উম্ম এ- হযরত ইবনে আব্বাস (রা) সূতে নবী (সা) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি (সা) ইরশাদ করেন-
ترفع الْأَيْدِي فِي الصَّلَاة وَإِذا رأى الْبَيْت وعَلى الصَّفَا والمروة وعَلى عَرَفَات وبجمع وَعند الْجَمْرَتَيْن وعَلى الْمَيِّت
হাত উত্তোলন করা হয় সালাতে, বায়তু্ল্লাহর প্রতি নযর পড়লে, সাফা ও মারওয়ায়, আরাফাতে, মুযদালিফায়, দুই জামরার পাশে, আর মৃতের উপর।