তাফসীর আদ দুররে মানসূর tafsir ad durre mansur

সূরা আল বাকারা ১৫৫-১৫৭ আয়াতের তাফসীরের অংশ বিশেষ

তাফসীর আদ দুররে মানসূর প্রথম খণ্ড, সূরা আল ফাতিহা ও সূরা আল বাকারা ১-১৪৩, পৃ: ৫৩৩ এর জন্য whatsapp/telegram অথবা ইমেইল করুন darussaadat@yahoo.com এ।

وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَيْءٍ مِنَ الْخَوْفِ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ مِنَ الْأَمْوَالِ وَالْأَنْفُسِ وَالثَّمَرَاتِ وَبَشِّرِ الصَّابِرِينَ (155)

 الَّذِينَ إِذَا أَصَابَتْهُمْ مُصِيبَةٌ قَالُوا إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ (156)

 أُولَئِكَ عَلَيْهِمْ صَلَوَاتٌ مِنْ رَبِّهِمْ وَرَحْمَةٌ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُهْتَدُونَ (157)

১৫৫. আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব কোন একটি বিষয়ের সাথেভয়, ক্ষুধা, জান মাল অথবা ফল ফসলের ক্ষতি দ্বারা। ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও।

১৫৬. যখন তাদের উপর বিপদ আপতিত হয় তখন বলে, নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর জন্য আর নিশ্চিত আমরা তার দিকে ফিরে যাব।

১৫৭. এরাই তারা যাদের প্রতি তাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে অনুগ্রহ ও রহমত বর্ষিত হয় আর এরাই সুপথপ্রাপ্ত।

মাম ইবনে জারীর, ইবুল মুনযির, ইবনে আবী হাতিম, তাবরানী এবং বায়হাকী শুআবুল ইমানে- হযরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকে {وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ} الْآيَة  প্রসঙ্গে বর্ণনা করেন যে, আল্লাহ তাআরা ইমানদারদের সংবাদ দিচ্ছেন যে, দুনিয়া মুসিবতের ঘর। আল্লাহ তাআলা তাদেরকে এই দুনিয়াতে পরীক্ষায় নিপতিত করবেন। আর এজন্য সবরের নির্দেশ প্রদান করেছেন এবং সুসংবাদ দান করেছেন যে وَبَشِّرِ الصَّابِرِينَ ।  

আল্লাহ তাআলা সংবাদ দিচ্ছেন যে, মুমিন যখন আল্লাহর ফয়সালার সামনে ঝুঁকে যায় এবং মুসবিতের সময় ইন্না লিল্লাহ পাঠ করে তখন আল্লাহ তাআলা তার জন্য তিনটি কল্যাণ লিখে দেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে করুণা, রহমত ও হিদায়াত। রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি মুসীবতের সময় ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ পাঠ করে আল্লাহ তাআলা তার মুসিবতের ক্ষতিপূরণ করেন। তার পরিনাম কল্যাণকর করেন এবং তার উত্তম বিনিময় দান করেন যার দ্বারা সে সন্তুষ্ট হয়। 

মাম আব্দ হুমায়দ, ইবনে জারীর, ইবনুল মুনযির, ইবনে আবী হাতিম- রাজা বিন হায়ওয়াহ থেকেوَنقص من الثمرات  ফল ফসলের ক্ষতি প্রসঙ্গে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, লোকদের উপর এমন সময়ও আসে যে, খেজুর গাছে ফল আসে না একটা খেজুর ব্যতীত।

মাম তাবরানী, ইবনে মারদুবিয়াহ- হযরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন। রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেন, আমার উম্মতকে এমন একটি জিনিস দেয়া হয়েছে যা অন্য কোন উম্মতকে দেওয়া হয়নি। আর তা হল মুসীবতের সময়  ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ পাঠ করা।

মাম ইবনে আবিদ দুনইয়া এবং বায়হাকী- আব্দুল্লাহ ইবনে আমর থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, যার মধ্যে চারটি গুণ থাকবে তার জন্য আল্লাহ তাআলা জান্নাতে ঘর তৈরী করবেন। (১) যার অলঙ্কার হবে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ (অর্থাৎ যে সর্বদা এর যিকির করবে) (২) যখন বিপদ আসে তখন ইন্না লিল্লাহ পাঠ করে। (৩) যখন তার কিছু লাভ হয় তখন আলহামদুলিল্লাহ বলে। (৪) আর যখন তার কোন গুনাহ হয় তখন ক্ষমা প্রার্থনা করে।  

মাম ইবনে আবিদ দুনইয়া আল আযায়- ইউনুস বিন ইয়াযিদ থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আমি রবিয়া বিন আব্দুর রহমান কে জিজ্ঞাসা করলাম, সবরের চূড়ান্ত সীমা কি? তিনি বললেন, তুমি মুসীবতের দিন তেমনই থাক যেমন মুসীবতের পূর্বে ছিলে।

মাম হাকীম তিরমিযী- আনাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন। রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেন, কোন নিআমত যদিও তার উপর অনেক সময় অতিবাহিত হয়ে যায়, আর বান্দা তার জন্য শোকর করে, তখন আল্লাহ তাআলা এর জন্য তাকে ঐ সময় প্রতিদান দান করেন। আর যদি কোন মুসীবত- যদিও তার উপর অনেক সময় অতিবাহিত হয়ে যায়, বান্দা এর জন্য ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ পাঠ করে তখন আল্লাহ তাআলা ঐ সময় তাকে (পুনরায়) সওয়াব দান করেন।

মাম ইবনে আবিদ দুনইয়া আল আযায়- সাইদ ইবনুল মুসায়িব থেকে মারফুরুপে বর্ণনা করেন। যে ব্যক্তি (বিপদের) চল্লিশ বছর পর ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’  পাঠ করল আল্লাহ তাআলা তাকে মুসীবতের দিনের মত সওয়াব দান করবেন।

মাম আহমদ এবং বায়হাকী শুআবুল ইমানে- হযরত উম্মে সালামা (রা) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আবু সালামা (রা) একদিন রাসূলুল্লাহ (সা) এর সাথে দেখা করে আমার নিকট আসল এবং বলল, আজ আমি রাসূলুল্লাহ (সা) এর নিকট থেকে একটি কথা শুনেছি যার কারণে আমি খুব আনন্দিত। তিনি বলেছেন, কোন মুসলমানের উপর বিপদ আসলে সে যদি ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’  পাঠ করে অতঃপর বলে-

اللهُمَّ أْجُرْنِي فِي مُصِيبَتِي، وَاخْلُفْ لِي خَيْرًا مِنْهَا

হে আল্লাহ! আপনি আমার এই বিপদে প্রতিদান দিন আর এর পরিবর্তে আমাকে উত্তম বিনিময় দান করুন।

তাহলে আল্লাহ তাআলা এমনই করেন (উত্তম বিনিময় দান করেন)।

উম্মে সালামা (রা) বলেন, আমি দুআটি মুখস্থ করে নিলাম। যখন আবু সালামার মৃত্যু হল তখন আমি (‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’) পাঠ করলাম এবং (অনুরুপ) বললাম।

এরপর আমি বললাম, আমার জন্য আবু সালামা থেকে উত্তম আর কে হতে পারে। (কিন্তু) আল্লাহ তাআলা আমাকে আবু সালামার উত্তম বিনিময় রাসূলুল্লাহ (সা)-কে দান করলেন।

মাম তাবরানী- হযরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন। রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেন, নিশ্চয়ই মৃত্যুর কারণে অস্থিরতা হয়। যখন তোমাদের মাঝে তোমাদের কারো ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ আসে তাহলে তোমাদের পাঠ করা উচিত-

إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ وَإِنَّا إِلَى رَبِّنَا لَمُنْقَلِبُونَ

ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন ওয়া ইন্না ইলা রাব্বিনা লামুনকালিবূন।

নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর এবং আল্লাহর দিকে আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে। আমরা আমাদের প্রতিপালকের নিকট অবশ্যই প্রত্যবর্তন করব।

মাম তাবরানী যয়ীফ সনদে- হযরত আবু উমামাহ (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) এর জুতার ফিতা ছিঁড়ে গেলে তিনি ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’  পাঠ করলেন। সাহাবীগণ আরয করলে, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এটাও কি মুসিবত? তিনি (সা) ইরশাদ করলেন,

مَا أَصَابَ الْمُؤْمِنَ مِمَّا يَكْرَهُ، فَهُوَ مُصِيبَةٌ

মুমিনের উপর যে অপছন্দনীয় বিষয়ই আপতিত হয় তা-ই মুসিবত।

মাম ইবনে আবী শায়বাহ এবং ইবনে আবিদ দুনইয়া- হযরত আউফ বিন আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, যার জুতার ফিতা ছিঁড়ে যায় তার উচিত ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ পাঠ করা কেননা এটাও মুসিবত।

মাম আব্দ ইবনে হুমায়দ, ইবনে আবিদ দুনইয়া আল আযায়- হযরত ইকরিমা থেকে বর্ণনা করেন। রাসূলুল্লাহ (সা) এর বাতি নিভে গেলে ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ পাঠ করলেন। জিজ্ঞাসা করা হল ইয়া রাসূলাল্লাহ! এটাও কি মুসিবত? তিনি (সা) বললেন,

نعم وكل مَا يُؤْذِي الْمُؤمن فَهُوَ مُصِيبَة لَهُ وَأجر

হ্যাঁ প্রত্যেক ঐ জিনিস যার দ্বারা মুমিনের কষ্ট হয় তা-ই মুসিবত আর এর উপর সওয়াব রয়েছে।

মাম আব্দ ইবনে হুমায়দ- হযরত হাসান থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, যখন তোমার জামাতের সাথে নামায ছুটে যায় তখন ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ পাঠ কর, কেননা এটাও মুসীবত 

মাম সাদ- হযরত খায়সামা থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, যখন আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) এর নিকট তার ভাই উতবার মৃত্যুর সংবাদ পোঁছল, তখন তার চোখে পানি এসে গেল। তিনি বললেন, এটা আল্লাহর রহমত যা তিনি সৃষ্টি করেছন। মানুষ এর উপর ক্ষমতা রাখে না।

মাম আহমদ, আব্দ ইবনে হুমাযদ, বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, আবু দাউদ, নাসাঈ- হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, নবী (সা) এক মহীলাকে তার মেয়ের জন্য কাঁদতে দেখে বললেন, আল্লাহকে ভয় কর এবং সবর কর। মহীলাটি বলল, আমার মুসীবত সম্পর্কে আপনার ধারণা নেই। যখন ঐ মহীলাকে বলা হল ইনি আল্লাহর রাসূল। তখন সে খুব পেরেশান হল এবং নবী (সা) এর দরবারে আসল এবং তার দরবারে কোন দ্বার রক্ষী পেল না। সে আরয করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আপনাকে চিনতে পারিনি। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন,

إِنَّمَا الصَّبْرُ عِنْدَ أَوَّلِ صَدْمَة

প্রথম আঘাতে ধৈর্যধারণ করাই প্রকৃত ধৈর্য।

মাম আব্দ ইবনে হুমায়দ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ এবং বায়হাকী শুআবুল ইমানে- হযরত ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণনা করেন। রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেন, যে দুই মুসলমানের (স্বামী-স্ত্রীর) তিনটি বাচ্চা প্রাপ্তবয়ষ্ক হওয়ার পূর্বেই মৃত্যুবরণ করেছে, তারা তাদের জন্য জাহান্নাম থেকে বাঁচার উপায়। আবু যার (রা) বললেন, যার দুটি বাচ্চা মৃত্যবরণ করেছে? তিনি (সা) বললেন, দুটি হলেও। আবুল মুনযির সাইয়্যিদুল কুররা বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার একজন বাচ্চা মারা গেছে। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, একটি হলেও। আর এটি হল প্রথম দুঃখ। 

মাম মালিক মুআত্তায় এবং বায়হাকী শুআবুল ইমানে- হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন। রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেন,

مَا يَزَالُ الْمُؤْمِنُ يُصَابُ فِي وَلَدِهِ وَحَامَّتِهِ، حَتَّى يَلْقَى اللهَ وَلَيْسَتْ لَهُ خَطِيئَةٌ

মুমিনের উপর তার সন্তান ও তার  প্রয়োজনের উপর বিপদ মুসিবত আসতেই থাকে, এমনকি যখন সে আল্লাহর সাথে মিলিত হয় তখন তার কোন গুনাহই থাকে না।

মাম নাসাঈ- হযরত ইবনে উমর (রা) থেকে বর্ণনা করেন। রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেন,

إِنَّ اللَّهَ لَا يَرْضَى لِعَبْدِهِ الْمُؤْمِنِ إِذَا ذَهَبَ بِصَفِيِّهِ مِنْ أَهْلِ الْأَرْضِ فَصَبَرَ وَاحْتَسَب بِثَوَاب من الْجَنَّةِ

পৃথিবীর কোন প্রিয়জন মারা যাওয়ার পর যখন মুমিন ব্যক্তি ধৈর্যধারণ করে  এবং সওয়াবের আশা রাখে তখন আল্লাহ তাআলা তার জন্য জান্নাত ছাড়া অন্য কোন প্রতিদান দিয়ে সন্তুষ্ট হন না।

মাম ইবনে সাদ- মুতাওয়াফ [মুতারাফ] ইবনে আব্দুল্লাহ শিখখীর থেকে বর্ণনা করেন যে, তার ছেলে আব্দুল্লাহ মৃত্যুবরণ করলে ভালো পোষাক পড়ে চুল আচঁড়িয়ে (পরিপাটি হয়ে) বাহিরে আসেন। তাকে এই মুহুর্তে এমন সজ্জার কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, আল্লাহ তাআলা দুটি মুসীবতরে জন্য তিনটি জিনিসের ওয়াদা করেছেন। অর প্রত্যেকটি জিনিস আমার পুরো দুনিয়া থেকে উত্তম। আল্লাহ তাআল ইরশাদ করেছেন-

{الَّذِينَ إِذَا أَصَابَتْهُمْ مُصِيبَةٌ} إِلَى قَوْله {الْمُهْتَدُونَ}

‘আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব’ থেকে নিয়ে‘ এরাই সুপথপ্রাপ্ত।’ পর্যন্ত।

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to top button
error: Content is protected !!